যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ থাকলে ওই ঋণ কোনো মামলা ছাড়াই অবলোপন বা ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে বাদ দেওয়া যাবে। একই সঙ্গে মৃত কোনো ব্যক্তির নামে বা তার একক মালিকানাধীন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা যে কোনো অঙ্কের খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যাবে। তবে অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে এবং ঋণ অবলোপনের পর ঋণ আদায়ের আইনগত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রোববার একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে সার্কুলারে বলা হয়েছে। আগে এই ধরনের বিধান ছিল না। আগে খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে হলে মামলা করতে হতো। তারপর ওই ঋণ অবলোপন করা যেত। মামলা ছাড়া কোনো ঋণ অবলোপন করা যেত না। এ কারণে বিশেষ করে ছোট অঙ্কের ঋণগুলো অবলোপন করা যাচ্ছিল না। বিশেষ করে যেসব ঋণের কোনো উত্তরাধিকার নেই, ওইসব ছোট ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। ফলে ঋণের বিপরীতে মামলা করলে ব্যাংকের আরও বাড়তি খরচ হচ্ছে। এ কারণে মামলা ছাড়াই ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করে কমানো সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলো ৫৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। ঋণ আদায় না হওয়ার কারণে এখন খেলাপি ঋণ কমাতে তা অবলোপন করার কৌশল নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেননা, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ঋণের শর্ত রয়েছে ২০২৬ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশ ও সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক খাত সংস্কারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত রোডম্যাপে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে ৮ শতাংশের নিচে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বা ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সার্কুলারে বলা হয়, কোনো ঋণ ২ বছর মন্দা হিসাবে খেলাপি থাকলে ওই ঋণ অবলোপন করা যাবে। তবে কোনো মৃত ব্যক্তির নামে ঋণ যে মানেই বা যে অঙ্কেই খেলাপি হিসাবে থাকুক না কেন তা ব্যাংক নিজ বিবেচনায় অবলোপন করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকার বেশি হলে তার বিপরীতে মামলা করতে হবে না। তবে একক মালিকানাধীন কোম্পানির ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির উত্তরসূরি থাকলে তা বিবেচনায় নিতে হবে।
অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে কোনো বন্ধকী সম্পত্তি থাকলে তা আগে বিক্রির চেষ্টা করতে হবে। ঋণের জামিনদারের কাছ থেকেও ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এসব পদক্ষেপে ঋণ আদায় না হলে তা অবলোপনের উদ্যোগ নিতে হবে। ৫ লাখ টাকার বেশি হলে ওই ঋণ অবলোপনের আগে মামলা করতে হবে।
সার্কুলারে অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে প্রভিশনের শর্তও শিথিল করা হয়েছে। আগে সুদসহ পুরো খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হতো। এখন তা শিথিল করে ঋণের শুধু মূল অংশের ওপর শতভাগ প্রভিশন রাখার বিধান করা হয়েছে। আরোপিত সুদ আলাদা একটি হিসাবে রাখতে হবে। কোনো ঋণ হিসাব আংশিকভাবে অবলোপন করা যাবে না। অবলোপনের আগে ব্যাংকের পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ঋণ অবলোপন করা যাবে না।
এতে আরও বলা হয়, কোনো ঋণ অবলোপন করা হলেও ওই ঋণের ওপর ব্যাংকের দাবি চলমান থাকবে। ফলে ঋণ আদায়ের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এসব ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নেতৃত্বে একটি আলাদা অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট গঠন করতে হবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ ইউনিট গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হবে। আগামী এক মাসের মধ্যে এই ইউনিটে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তা নিয়াগ দিতে হবে। ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে অবলোপন করা ঋণ আদায়ের শর্ত থাকতে হবে। এমডির পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে অবলোপন করা ঋণের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা আদায়ের হার বিবেচনা করতে হবে।
ঋণ আদায়ের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রণোদনা হিসাবে এর একটি অংশ পাবেন। অবলোপন করা ঋণের মধ্যে আদায় হয়েছে এমন ঋণের ৫ শতাংশ অর্থ এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা অতিরিক্ত প্রণোদনা হিসাবে পাবেন। এ খাতে বিতরণ করা মোট অর্থের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পাবেন এমডি।
সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ কোম্পানি গঠিত হলে ব্যাংকগুলো অবলোপন করা ঋণ বিক্রি করতে পারবে। এর বিপরীতে পাওয়া অর্থ আয় খাতে নেওয়া যাবে। ঋণ অবলোপন করা হলেও গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন।