দোকানে চুরিতে জড়িত সন্দেহে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে দুই কিশোরের ওপর রাতভর নির্যাতন চালানো হয়েছে। রোববার রাতে তাদের মোবাইল ফোনে ডেকে আনা হয়। পরে রাত দুইটা থেকে সোমবার ফজরের আজান পর্যন্ত চালানো হয় নির্যাতন। সকালে সালিশ বসিয়ে তাদের জরিমানা করা হয় ৩০ হাজার টাকা। এক কিশোরের মায়ের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দেওয়া হয় দুজনকে। বর্তমানে তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
জগন্নাথপুর ইউনিয়নের তারাপুর বাজারে ঘটে এই নির্যাতনের ঘটনাটি। ভুক্তভোগী দুই কিশোরের বয়সই ১৭। তারা তারাপুর গ্রামের বাসিন্দা। গত শিক্ষাবর্ষের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তারাপুর বাজারে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা রয়েছে একই এলাকার আবুল কালাম আজাদের। সেখানে স্থানীয় কিশোর-তরুণেরা অবসর সময়ে ক্যারাম খেলে। রোববার সন্ধ্যায় আজাদের দাদি মারা যান। সংবাদ পেয়ে তিনি দোকান বন্ধ করে দাদির বাড়িতে যান। রাত ১১টার দিকে দোকানে ফিরে দেখেন, পেছনের দরজা খোলা। ড্রয়ার থেকে টাকা-সিগারেটসহ কিছু পণ্য খোয়া গেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নেওয়ার পর তিনি ওই দুই কিশোরকে সন্দেহ করেন।
পরবর্তীতে রাত ২টার দিকে ফোনে তাদের বাজারে ডেকে আনেন আজাদ। দোকানে আটকে রেখে ওই দুজনের ওপর কাঠ ও বাঁশের লাঠি দিয়ে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। এক পর্যায়ে দুই কিশোরের কাছ থেকে চুরির স্বীকারোক্তি আদায় করে তারা। এলাকাবাসী জানায়, নির্যাতনে অংশ নেন আজাদ, তার চাচাতো ভাই মিজান, হাসানসহ বেশ কয়েকজন।
মারধরের ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সোমবার দুপুরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে এক কিশোরের হাত-মুখ ও গলা চেপে ধরে রেখেছেন। আরেকজন বাঁশের লাঠি দিয়ে মারধর করছে। এ সময় ‘আমি কিছু করি নাই, ও মা.. গো বলে’ চিৎকার করতে শোনা যায় ওই কিশোরকে।

সোমবার সকালে বাজারের পাশের একটি করাতকলে এ নিয়ে সালিশ বসান জগন্নাথপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাস। সেখানে ব্যবসায়ী আজাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই কিশোরকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এরপর এক কিশোরের মা ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দুজনকে বাড়ি নিয়ে আসেন। পরে সকাল ১০টার দিকে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলার বারান্দায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাওয়া যায় তাদের। হাত-পা, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।
এক কিশোর বলে, ‘আজাদের দোকানে আমরা নিয়মিত ক্যারাম খেলি। গতকাল (রোববার) রাতেও বাজারে ছিলাম। এরপর রাত ১১টার দিকে নন্দলালপুরে খালাদের বাড়ি গিছিলাম। রাত ২টার দিকে হঠাৎ আজাদ বারবার বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে কল দিতে থাকে। পরে আমরা বাড়িতে আসলে আজাদ, তার চাচাতো ভাই মিজান, হাসানসহ অনেকেই আমাদের বাড়ি থেকে তুলে বাজারে নিয়ে যায়। সেখানে ফজরের আজান পর্যন্ত বাঁশের লাঠি ও কাঠের বাটাম দিয়ে মারপিট করে আটকে রাখেন।’
অপর কিশোরের ভাষ্য, ‘আমরা চুরি করিনি। তবুও সন্দেহ করে হাতে-পা ও পিঠসহ সবখানে সারারাত প্রচুর মারেছে ওরা। পরে সকালে করিম মেম্বর সালিশে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে ছাড়া পাই।’
প্রথম কিশোরের মা বলেন, ‘আমার ছেলে চুরি করেনি। তবুও অমানবিকভাবে মারেছে। চিকিৎসা করার জন্য জরিমানা মেনে নিয়ে অগ্রিম ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। আমরা এর বিচার চাই। কিন্তু করিম মেম্বররা তো প্রভাবশালী। আমাদের বিচার করে দেবে কে।’
অপরজনের মা বলেন, ‘আমরা থানায় যাব। মামলা করব। এমন মারা কেউ মারে!’
বিকেলে তারাপুর বাজারে গিয়ে আজাদের দোকান বন্ধ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে কোনো ব্যবসায়ী বা স্থানীয় লোকজন কথা বলতে রাজি হননি। দোকানের সামনেই আজাদের বসতবাড়ি। তিনি বলেন, দাদি মারা যাওয়ার খবরে সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে চলে যান। রাত ১১টার দিকে ফিরে দেখেন, পেছনের দরজা খোলা। ড্রয়ারে রাখা ৫৫ হাজার টাকা, কিছু সিগারেট ও অন্যান্য মালামাল নেই। পরে খোঁজ নিয়ে দুইজনের প্রতি সন্দেহ হয়। এরপর সবাই মিলে ওদের ডেকে বাজারে আনেন।
তার দাবি, উৎসুক জনতা ওদের মারধর করে। পরে ওরা চুরির কথা স্বীকারও করে। বিএনপি নেতা করিম সকালে সালিশ বসিয়ে সমাধান করেন। সালিশে ১৫ হাজার টাকা করে দুজনকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একজন ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। তা করিমের কাছে আছে।
জগন্নাথপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাস বলেন, ‘চোরকে গণপিটুনি দিয়ে জনগণ আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এনেছিল। আমি তাদের এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তবে সালিশ করিনি।’
তার ভাষ্য, ‘শুনেছি ৩৭ হাজার টাকা চুরি হয়েছে। ৩০ হাজার টাকায় মিটমাট হয়েছে।’
এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয় উল্লেখ করে কুমারখালী থানার ওসি খন্দকার জিয়াউর রহমান বলেন, চুরির অভিযোগে মারধরের কথা শুনেছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
NEWS21 staff Musabbir khan 
























