১ জানুয়ারি ১৪৯২ মুসলিম গ্রানাডার পতন ঘটে। এটা ছিল স্পেনে সর্বশেষ মুসলিম দুর্গ। সমগ্র স্পেন খ্রিস্টানদের দখলে চলে যাওয়ার পর মুসলিমদের ধর্মান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেটাই ছিল স্পেনে একজন মুসলমানের টিকে থাকার একমাত্র বিকল্প।
১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মুররা (যেসব মুসলিম ধর্মান্তরিত হয়েছিল বা খ্রিস্টান পরিচয়ে মুসলিম পরিচয় আড়াল করেছিল) খ্রিস্টান শাসনের বিরুদ্ধে গ্রানাডার আলপুজাররাস পাহাড়ি অঞ্চলে একটি প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এরপর ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে শাসক পরিবার নির্বিচারে মুরদের স্পেন থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬১৪ সালে সর্বশেষ মুর পরিবার আইবেরিয়ান উপদ্বীপ (আধুনিক স্পেন ও পর্তুগাল) ত্যাগ করে। তারা ছিল রিকোটের বাসিন্দা।
মূলত শাসকরা স্পেনকে এক ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের দেশে পরিণত করতে চাইছিল। কয়েক শতক ধরে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, স্পেনে বসবাস করতে হলে অবশ্যই খ্রিস্টান হতে হবে। এর অন্যথা হলে ব্যক্তিকে পুড়ে মরার শাস্তি ভোগ করতে হবে। খ্রিস্টধর্ম ত্যাগকারীদের নির্যাতন করাই ছিল রাষ্ট্রীয় তদন্তকারীদের মূল কাজ।
কোনো মুসলিম বা ইহুদি ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাস গ্রহণের ঘোষণা দিলেও রাষ্ট্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো তাদের প্রতি সূক্ষ্ম নজর রাখত। তাদের মধ্যে পূর্বধর্ম চর্চার প্রমাণ পেলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। তাদের বলা হতো নতুন খ্রিস্টান। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কিছু মুসলিম ও ইহুদি আত্মরক্ষার জন্য আমেরিকায় পালিয়ে যান। পেরুর লিমায় এমন কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রীয় প্রচণ্ড বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ১৫৬০ থেকে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পরিচয় আড়াল করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে মুসলিমরা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ইসলাম গোপন রাখার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি কিছু ব্যক্তির তথ্য পাওয়া যায় বিচারিক নথিতে। এমন একজন হলেন আমির সিগালা। তিনি নিজেকে গ্রেগোরিও জাপাতা বলে পরিচয় দিতেন। তিনি স্পেনের রাজকীয় সামরিক বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। বলিভিয়ার পোতোসিতে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ফেরার পর জানা যায়, তিনি মূলত একজন মুসলিম এবং তাঁর নাম আমির সিগালা।
মুসলমানদের দেশ থেকে বহিষ্কার করলেও স্পেনের ভাষা ও সংস্কৃতিতে ইসলামী সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়ে গেছে। কাস্তালিয়ান ভাষা, যাকে স্প্যানিশ ভাষার আদর্শ (আধুনিক ও প্রমিত) শাখা বলা হয়, এর মূল ভিত্তি লাতিন হলেও ভাষাটির ওপর আরবি ভাষার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়। স্প্যানিশ ভাষার আধুনিকায়নে আরবি ভাষার অবদানও অসামান্য। আধুনিক স্প্যানিশ ভাষার চার হাজারেরও বেশি পরিভাষা সরাসরি আরবি ভাষা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। আরবি ভাষা থেকে গৃহীত শব্দগুলোর বেশির ভাগ মানবীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত; যেমন—শিল্প, বিজ্ঞান, কৃষি, খনি, নৌবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ও আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তি ইত্যাদি।
স্প্যানিশ সমাজে মুসলমানের এই প্রভাব বিস্তার এবং তা স্থায়ী হওয়ার কারণ একাধিক। প্রথমত, আরবরা স্পেন জয় করার সময় তা ছিল রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। মুসলিমরা স্পেনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে এসেছিল। ফলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসে।
দ্বিতীয়ত, মুসলিমদের বিশ্বজয়। সে সময় ভূমধ্যসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত মুসলিম শাসন বিস্তৃত হওয়ায় বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি আত্মস্থ করার মাধ্যমে মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। মুসলমানের রাজনৈতিক প্রভাবও মানুষের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলেছিল। এ ছাড়া ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির পতন ঘটার পর ইসলামই ছিল স্প্যানিশ ও ইউরোপিয়ানদের জন্য সর্বোত্তম বিকল্প। ইসলামের প্রতি ইউরোপিয়ানদের মুগ্ধতার প্রমাণ হলো স্পেনের পতনের সময় মুসলিম জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের চার ভাগই ছিল ধর্মান্তরিত মুসলিম।
জার্মান রাজপুত্র (পরে রাজা) অটো দ্য গ্রেটের খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে গ্রানাডা সফর করেন। সফরের পর তিনি মন্তব্য করেন, গ্রানাডাকে শুধু অসাধারণ বাগদাদের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। এ ছাড়া তিনি গ্রানাডার অধিবাসীদের আরব পোশাক পরিধান ও ভাষা ব্যবহার করতে দেখেন। তাদের ভাষাকে আলগারাবিয়া বলা হতো, যা মূলত আরবি ও রোমান ভাষার মিশ্রণে গড়ে উঠেছিল। তাদের খাদ্যরীতি ও জীবনযাপনও ছিল আরবীয় রীতিতে।