কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশে এখন পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। চলতি মাসেই বাজারে আসছে অন্তত ৭৫ হাজার টন নতুন দেশি পেঁয়াজ। তার পরও বাজারে এক সপ্তাহ ধরে চলছে অস্বাভাবিক অস্থিরতা। কেজিতে দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের সরাসরি কারসাজির তথ্য জানার পরও পেঁয়াজের দাম কমাতে দ্রুত আমদানির অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিব ও কৃষি সচিবকে পাঠানো চিঠিতে বিটিটিসি জানায়, বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে। তাই সরবরাহ বাড়াতে আমদানির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। তবে সংস্থাটি একই সঙ্গে স্বীকার করেছে, পেঁয়াজের বাজারে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি সরাসরি দায়ী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, আমদানিকারকদের একটি অংশ আমদানির অনুমতি না পেয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ মুহূর্তে আমদানির অনুমতি দিলে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শিগগিরই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
গত সপ্তাহে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি
ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশে পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন, স্থানীয় বাজারমূল্য, আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য, বিদ্যমান আমদানি শুল্কসহ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্যারিফ কমিশন বলছে, ২০২৩ সালের মার্চে পেঁয়াজের মূল্য গড়ে কেজিপ্রতি ৩৩ টাকা ছিল, যা নভেম্বরে দাঁড়ায় ১১৫ টাকায়। অর্থাৎ, মার্চের তুলনায় নভেম্বরে দাম বাড়ে ২৪৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের এপ্রিলে গড় মূল্য ছিল ৬৩ টাকা, যা নভেম্বরে বেড়ে হয় ১৩০ টাকা। সেই হিসাবে এপ্রিলের তুলনায় নভেম্বরে দাম বেড়েছে ১০৬ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে সর্বনিম্ন দর ছিল ৪২ টাকা, যা নভেম্বরে ১৫০ শতাংশ বেড়ে হয় ১০৫ টাকা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, পেঁয়াজের দাম মার্চ-এপ্রিলের তুলনায় নভেম্বরে ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। এ ধরনের সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রয়োজন। এ বছরও মুড়িকাটা পেঁয়াজের রোপণ সময়কাল বিলম্বিত হওয়ায় তা উৎপাদন মৌসুমেও বিলম্বিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয় বাজারমূল্য বিবেচনায় দেখা যায়, গত দুই-তিন মাসে পেঁয়াজের মূল্য স্থিতিশীল থাকলেও গত এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৩৭ থেকে ৪২ শতাংশ। প্রতিবছর অক্টোবর-ডিসেম্বরে দাম বাড়ার প্রবণতা থাকলেও গত সপ্তাহে দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে, যা বাজার ব্যবস্থাপনা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির সরাসরি ইঙ্গিত দেয়।
আমদানির সুপারিশের পেছনে যুক্তি
ট্যারিফ কমিশন বলছে, পার্শ্ববর্তী দেশে পেঁয়াজের দাম এখন কেজিতে প্রায় ১৬ টাকা, অর্থাৎ টনে ১৯৫ ডলার। সেই হিসাবে ১০ শতাংশ শুল্ককর বহাল রেখেও পেঁয়াজ আমদানি করা গেলে দেশে কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কম দামে বিক্রি করা সম্ভব।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সাত লাখ ৬০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল; ২০২৩-২৪ সালে তা কমে হয় ছয় লাখ ১৪ হাজার টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নেমে আসে চার লাখ ৮৩ হাজার টনে। এই আমদানির ৯৯ শতাংশই ভারত থেকে আসে।
কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান বলেন, কিছু মধ্যস্বত্বভোগী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল করছে। পেঁয়াজের কেজি এই সময়ে ৯০ টাকার মধ্যে থাকার কথা; কিন্তু ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশে দাম এখন প্রায় ৩০ টাকার মতো। তাই দ্রুত আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে সরবরাহ বাড়বে, দামও স্বাভাবিক হবে।
কমিশন বলছে, পেঁয়াজের সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপেই মধ্যস্বত্বভোগীরা নির্ধারিত লাভে বিক্রি করেন। এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। পেঁয়াজের প্রকৃত সংগ্রহের মৌসুম বলতে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে বোঝায়। তাই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রোধ করতে সরকারিভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের প্রস্তুতি, ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় কাঠামো দরকার। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বর্তমানে সরকারিভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের কোনো হিমাগার নেই। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পেঁয়াজ কৃষক নিজ বাসস্থানে সংরক্ষণ করেন। এ অবস্থায় প্রকৃত সংগ্রহ মৌসুমে পেঁয়াজ সরকারিভাবে সংরক্ষণ করাসহ প্রয়োজনীয় সংরক্ষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে।
কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা
কৃষি মন্ত্রণালয় এখনই আমদানির অনুমতির বিষয়ে রাজি নয়। তাদের যুক্তি, বাজারে নতুন দেশি পেঁয়াজ আসার প্রাক্কালে আমদানি শুরু হলে কৃষক ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হবেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, চলতি মাসে নতুন দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসছে। তাই এখনই আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন না, যা দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদনে অনীহা সৃষ্টি করবে। বর্তমানে যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত আছে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে তদারকি কার্যক্রম চলছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, আমাদের অগ্রাধিকার কৃষকের স্বার্থ রক্ষা। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ এখন মাঠে প্রস্তুত। দেশি উৎপাদন বাজারে এলে দাম কমে আসবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে দেশে ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্ষতি বাদ দিলে বাজারে আসে প্রায় ৩৩ লাখ ৩৬ হাজার টন। চলতি মাসে অন্তত ৭৫ হাজার টন দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে। ডিসেম্বরে আরও দেড় লাখ টন নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে। এ ছাড়া মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বাজারে পাওয়া যাবে। তাই কৃষি মন্ত্রণালয় মনে করছে, পেঁয়াজের কোনো ঘাটতির আশঙ্কা নেই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে দুই হাজার ৮০০টি আইপি আবেদন জমা পড়েছে। অনেক আমদানিকারক আইপি ছাড়াই এলসি খুলে পেঁয়াজ বন্দরে এনে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। পেঁয়াজের দাম যখন ৭০ টাকা ছিল, তখনও তারা আইপির জন্য হাইকোর্টে রিট করেছেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বর্তমানে দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত থাকা সত্ত্বেও বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে, যা মূলত মধ্যস্বত্বভোগী ও কিছু আমদানিকারকের কারসাজির কারণে। এই অবস্থায় আমদানির অনুমতি দিলে তারা সুবিধা পাবে। কারণ, এখন ভারতে পেঁয়াজের দাম কম। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। গত বছর উৎপাদন মৌসুমে আমদানির পর দাম কমে যাওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দুজন চাষি আত্মহত্যাও করেছেন। আমদানি না করে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও সংরক্ষণের দুর্বলতা কাটাতে হবে।
NEWS21 staff Musabbir khan 





















