আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে ৪৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা। বিগত বিসিএস পরীক্ষাগুলো মধ্যে এবারই প্রার্থীরা লিখিত প্রস্তুতির জন্য সবচেয়ে কম সময় পেতে যাচ্ছে। স্বল্প সময়ে লিখিত প্রস্তুতি গুছিয়ে নেওয়ার কৌশলগুলো জানাচ্ছেন ৩৫তম বিসিএস কর্মকর্তা ও ক্যারিয়ারবিষয়ক পরামর্শক রবিউল আলম লুইপা।
বিসিএস লিখিত প্রথমবারের প্রার্থীদের জন্য সিলেবাস ও পড়াশোনা সমুদ্রসম মনে হতে পারে। তবে একদিক থেকে পড়াশোনা শুরু করলে আস্তে আস্তে বিশাল সিলেবাসকেও স্বাভাবিক মনে হয় এবং নির্ধারিত সময়ে সিলেবাস শেষ করা যায়। কম সময়ে প্রার্থীদের যে বিষয়গুলো সচেতনভাবে লক্ষ করতে হবে সেগুলো হলো—
১. স্বল্প সময় বা পর্যাপ্ত সময় যেটিই হোক, নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করার একমাত্র কৌশল হলো রুটিন করে পড়া। সাধারণ সময়ে লিখিত সিলেবাসকে ৩ মাস (৯০ দিন) ভাগ করে পড়তে হয়। কিন্তু এবার সেটিকে ১.৫ মাস (৪৫ দিন) ভাগ করে শেষ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলা-১০ দিন, ইংরেজি-১০ দিন, বাংলাদেশ বিষয়াবলি-১০ দিন, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি-১০ দিন, সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-১০ দিন, গণিত- প্রতিদিন এই রুটিনটি অনুসরণ করা যেতে পারে অথবা ৪৫ দিনকে নিজের সুবিধামতো কাস্টমাইজ করেও নিতে পারেন। কোনো কারণে লিখিত পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে গেলে বাড়তি যে সময় পাওয়া যাবে, সেটি রিভিশন ও মডেল টেস্ট পরীক্ষার জন্য রাখতে পারবেন। গণিত এবং অনুবাদের জন্য প্রতিদিন ২–৩ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখুন।
২. যতটুকু পড়বেন, তার অর্ধেক সময় লিখবেন। যা পড়েছেন তা লিখবেন, পড়েননি এমন টপিকও ফ্রিহ্যান্ড লিখবেন। লিখিত প্রার্থীরা পরীক্ষায় বড় যে সমস্যা মোকাবিলা করেন সেটি হলো অল্প সময়ে লিখতে না পারা এবং ফ্রিহ্যান্ড লিখতে না পারা। আপনি অনেক পড়েছেন, কিন্তু লিখতে না পারলে সেই পড়া কোনো কাজেই আসবে না। সবচেয়ে ভালো হয় সময় ধরে ধরে প্রথমে অধ্যায়ভিত্তিক এবং পরবর্তী সময়ে পুরো সিলেবাস নিয়ে বিষয়ভিত্তিক মডেল টেস্ট দিন। মাথায় রাখবেন, লিখিত পরীক্ষার ৫ দিনে ২৪ ঘণ্টা লিখতে হবে।
৩. প্রত্যাশিত ক্যাডার পেতে হলে লিখিত পরীক্ষায় ৯০০ নম্বরের মধ্যে ৬০০+/- নম্বরের টার্গেট থাকতে হবে। আপনি সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের হলে আপনার স্ট্রেংথ উইকনেস একরকম হবে, নন-সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড হলে আপনার স্ট্রেংথ উইকনেস আরেক রকম হবে। দুর্বলতা আছে এমন বিষয়গুলো ডিফেন্সিভ মুড এবং ভালো পারেন এমন বিষয়গুলোতে বেশি নম্বর নিশ্চিত করুন। তবে সব সাবজেক্ট মিলিয়ে গড়পড়তা আপনাকে ৬০০ নম্বর তুলতেই হবে, এটি মাথায় রাখুন।
৪. লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার একটি কার্যকর কৌশল হলো উপস্থাপনা। মানসম্পন্ন লেখা থাকতে হবে এটি সত্য, কিন্তু উপস্থাপনা আপনাকে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে দেবে। সেটি গ্রাফ, চার্ট, ম্যাপ, কোটেশনের ক্ষেত্রেই বলুন অথবা হাতের লেখা, প্যারা প্যারা করে লেখার ক্ষেত্রেই বলুন। যেকোনো বিষয় অন্যদের মতো গতানুগতিক না লিখে সেটিকে তথ্য-উপাত্তগত বিশ্লেষণ ও ব্যতিক্রম করে উপস্থাপনা করুন। মনে রাখবেন প্রিলিমিনারি পরীক্ষার উত্তর সবারই একই রকম হয়, কিন্তু লিখিত পরীক্ষার উত্তর হবে আলাদা আলাদা।
৫. লিখিত পরীক্ষায় সময়বণ্টন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০০ নম্বরের পরীক্ষার জন্য প্রতি নম্বরের জন্য ১ মিনিট ১২ সেকেন্ড এবং ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় প্রতি নম্বরের জন্য ১ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড সময় পাওয়া যায়। তবে অনেক অল্প নম্বরের প্রশ্নও অধিক লিখতে হয় আবার অনেক বেশি নম্বরের প্রশ্নে অল্প লিখতে হয় (যেমন বাংলা সারমর্ম)। তাই প্রস্তুতির সময় থেকেই সময়বণ্টন নিয়ে ভাবুন।
৬. ৪৫তম ও ৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়—
ক) বাংলা ২০০ নম্বরের মধ্যে ব্যাকরণ-৩০ নম্বর এবং সাহিত্য-৩০ নম্বর, মোট ৬০ নম্বরের মধ্যে সবগুলো প্রশ্ন কমন পাওয়া গেলে ৬০ নম্বরও পাওয়া সম্ভব। তবে সাহিত্য অংশে ২/১টা আনকমন প্রশ্ন আসতে পারে, সেটি আগে থেকেই মাথায় রাখুন। রচনায় ৪০ নম্বরে ভালো নম্বর তুলতে বিগত প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে ১০/১৫টা রচনা সিলেক্ট করুন এবং তথ্য–উপাত্ত, কবিতার পঙ্ক্তি ও প্রয়োজনীয় অলংকরণ আগে থেকেই সাজিয়ে রাখুন।
খ) ইংরেজি ২০০ নম্বরের কমপ্রিহেনশন এবং অনুবাদ অংশে ভালো নম্বর তোলা সম্ভব। বর্তমানে কমপ্রিহেনশনগুলো একটু কঠিন লেভেলের আসে, তাই বিদেশি ওয়েবসাইট থেকে প্রস্তুতি নেওয়া একটি ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। অল্প সময়ে কমপ্রিহেনশন উত্তরের জন্য আগে প্রশ্নগুলোতে চোখ বুলিয়ে তারপর মূল কমপ্রিহেনশন পড়ুন। বাংলা বিষয়ের মতো ইংরেজি রচনার ক্ষেত্রেও আগে থেকে ১০/১৫টি রচনা বাছাই করে প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত, কোটেশন প্রস্তুত রাখুন।
গ) স্বল্প সময়ে নন-সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীদের গণিত প্রস্তুতি নিতে প্রচুর বেগ পেতে হয়, সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীদের এখানে অল্প সময় দিলেই হয়ে যাবে। নন-সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীদের বিগত প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে নিয়মিত আসে এমন অধ্যায়গুলো (যেমন সেট, বিন্যাস, সমাবেশ, ত্রিকোণমিতি ইত্যাদি) ভালো করে পড়ে কঠিন গণিতের কিছু নম্বর স্কিপ করে গণিত বিষয়টিকে ডিফেন্সিভ মোডে মোকাবিলা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মানসিক দক্ষতা প্রিলিমিনারি প্রস্তুতির সাথে ২/১ দিন রিভিশন দিলেই লিখিত প্রস্তুতি হয়ে যাবে।
ঘ) গণিতের মতো সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অংশটিও সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য সহজভাবে এবং নন-সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীদের জন্য ডিফেন্সিভ মোডে মোকাবিলা করতে হবে। সাধারণ বিজ্ঞান ও ইলেকট্রিক্যাল-ইলেকট্রনিকস অংশে কিছু কঠিন প্রশ্ন আসতে পারে, সে ক্ষেত্রে একদম না পারলে কিছু নম্বর স্কিপ হতে পারে, বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর অল্প প্রস্তুতিতেই কমন পেয়ে যাবেন।
ঙ) বাংলাদেশ বিষয়াবলি বিষয়ে পূর্বের বিসিএসে ৫ নম্বরের ২০টি প্রশ্ন এলেও সর্বশেষ ৪৫তম ও ৪৬তম বিসিএসে ১০ নম্বরের ১০টি প্রশ্ন এসেছে। ১০টি প্রশ্ন এলে ডেটা, চার্ট, গ্রাফ, ম্যাপ, কোটেশন প্রভৃতি তথ্য–উপাত্ত দেওয়ার জন্য মোটামুটি সময় পেলেও ২০টি প্রশ্ন এলে ফুল আনসার করার ক্ষেত্রেই জোর দিতে হবে। তবে যে ফরম্যাটেই প্রশ্ন করা হোক অল্প লেখায় অধিক তথ্য ও বিশ্লেষণ আপনার উত্তরকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করবে। স্বল্প সময়ে এত বড় সিলেবাসের প্রস্তুতি ও অধিক প্রশ্ন কমনের জন্য যে অধ্যায়গুলো থেকে নিয়মিত প্রশ্ন আসে (যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, সংবিধান, পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি) সেই অধ্যায়গুলো জোর দিয়ে পড়ুন।
চ) আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে অ্যানালাইটিক্যাল ইস্যু অংশ তুলনামূলক সহজ। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব (যেমন ইরান-ইসরায়েল, বাংলাদেশ-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রভৃতি) টপিকগুলোর বিস্তারিত ধারণা নিন। প্রবলেম সলভিং ইস্যু অংশে কতটুকু ভালো করতে পারবেন তা নির্ভর করবে আপনার বৈশ্বিক জ্ঞান ও নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ার ওপর। কনসেপচ্যুয়াল ইস্যু অংশে ২/১টা কঠিন ও আনকমন প্রশ্ন এলে সেটি ধারণা থেকে লেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন।
বিসিএস লিখিত প্রস্তুতিমূলক পরামর্শ অল্প লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। পুরো লেখার সারমর্ম হলো—সিলেবাস এবং বিগত প্রশ্ন অ্যানালাইসিস করে পড়ুন, ৪৫ দিনের রুটিন করে সিলেবাস শেষ করুন এবং নিয়মিত/সপ্তাহান্তে সময়বণ্টন করে মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে ফ্রিহ্যান্ড লেখার অভ্যাস করুন। আপনার লিখিত পরীক্ষা প্রত্যাশিত হবে আশা করছি।