ঢাকা ০৮:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

একাত্তরের ভুল স্বীকারে দ্বিধা, তবে লক্ষ্য ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’

  • প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০১:৪৯:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ২০ বার পড়া হয়েছে

ল্লাহর আইন চাই’– স্লোগান দেওয়া জামায়াতে ইসলামী শরিয়াহ্ শাসন কায়েমের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। দলটি বলছে, তাদের লক্ষ্য ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে ইসলামী সমাজের বদলে ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। 

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা জামায়াত একাত্তর প্রশ্নেও গত এক যুগে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তবে ক্ষমা চাইতে দলটির অভ্যন্তরে রয়েছে দ্বিধা। দলের একপক্ষের মত– ক্ষমা প্রার্থনায় লাভ হবে না। ভারতের বিষয়ে দলটির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। জামায়াত নেতারা সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। 

উদারীকরণের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে নারী নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে এনেছে জামায়াত। দলটির নারী নেতারা গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েক দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। 

জামায়াত আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় অমুসলিম সদস্যকে দলে ভেড়াচ্ছে। নারীদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করা হবে কিনা– এ নিয়ে দ্বিধা থাকলেও জামায়াত যে জোট করতে চাচ্ছে, সেখানে খোঁজা হচ্ছে অমুসলিম প্রার্থী। যদিও জামায়াতের গঠনতন্ত্রে রুকন (সদস্য) না হলে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করার সুযোগ নেই। তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক দল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে জামায়াত এতে ছাড় দিতে চায় বলে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন। 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হিজাববিহীন নারী এবং অমুসলিম প্রার্থী করেছে ছাত্রশিবির। তারা জয়ীও হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে একই কৌশল নিতে চায় জামায়াত। ডাকসুতে জয়ী ছাত্রশিবির নেতারা ১১ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জন্য দোয়া করেন দলীয় সিদ্ধান্তেই। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, উদারীকরণের অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে এমন কাজের ধারাবাহিকতা থাকবে। ক্ষমতায় যেতে পারলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া জামায়াত দলের লোগো বদল করে কিতাব ও কলম যুক্ত করেছে। গতকালই এই লোগো বদল করার বিষয়টি খবর হয়েছে।

জামায়াতে রক্ষণশীল এবং উদারপন্থির মতবিরোধ পুরোনো। ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো ধরপাকড়ের মুখে তা স্পষ্ট হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলীরা উদারপন্থি অংশে ছিলেন। একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করা নেতাদের বাদ দিয়ে কামারুজ্জামান নতুন নামে দল গঠনের জন্য কারাগার থেকে লিখিত পরামর্শ দিয়েছিলেন।

একাত্তরের জন্য ক্ষমা না চাওয়ায় ২০১৯ সালে জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এরও কয়েক বছর আগে তিনি তুরস্ক, তিউনিসিয়া ও মিসরের আদলে মধ্যপন্থি দল গঠনের পরামর্শ দিয়ে কলাম লিখেছিলেন। তাঁর চিন্তা ছিল, জামায়াত হবে সামাজিক সংগঠন। নির্বাচনে অংশ নেবে না। জামায়াত একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল থাকবে, যেখানে সব ধর্মের মানুষ থাকবে। তবে কারাগার থেকে আবু নকীব নামে লেখা কলামে সাবেক আমির মতিউর রজমান নিজামী এ চিন্তা নাকচ করেন।

তরুণ নেতাদের দাবির মুখে নতুন নামে দল গঠনে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান আমির এবং তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কমিটিও করেছিল জামায়াত। যদিও সেই উদ্যোগ দলটির মজলিসে শূরা অনুমোদন করেনি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে দল গঠন করিয়েছিল আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াত। উদ্দেশ্য ছিল, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে বিডিপির নামে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া। যদিও সেই দলকে নিবন্ধন দেয়নি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। গত বছর ৫ আগস্টের পর দলটি নিবন্ধন পেয়েছে।

গত বছর ১ আগস্ট জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ। গণঅভ্যুত্থানের পর তা প্রত্যাহার করে অন্তর্বর্তী সরকার। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হয়ে পড়ায় বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে জামায়াত। ক্ষমতায় গেলে কী কী করবে, সেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অতীতে কখনও ১৭ আসনের বেশি না পাওয়া দলটি। শফিকুর রহমান একাধিক বক্তব্যে বলেছেন, মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রই জামায়াতের লক্ষ্য।

ইসলামী সমাজ থেকে ইনসাফের সমাজের লক্ষ্য

২০০৬ সালে মুদ্রিত জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছিল, ‘… আল্লাহর বিধান ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি দিক এবং বিভাগে প্রতিষ্ঠা করিয়া মানুষ পার্থিব কল্যাণ এবং আখেরাতের সাফল্য অর্জন করিতে পারে; সেহেতু এই মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।’

২০০৮ সালে নিবন্ধনের সময় প্রথম গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৯ সালে সংশোধিত এবং গত বছর ডিসেম্বরে সর্বশেষ মুদ্রিত গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘… যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়া বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করিয়াছে, সেহেতু এই সকল মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত ন্যায় এবং ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।’

গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জামায়াত ২০১৬ সালে ‘শোষণমুক্ত ন্যায় এবং ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের’ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। পুরোনো গঠনতন্ত্রে দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কিত তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছিল, আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসুল (সা.) প্রদর্শিত দ্বীন কায়েম হবে জামায়াতের লক্ষ্য। সর্বশেষ মুদ্রিত গঠনতন্ত্রের একই ধারায় বলা হয়েছে, জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো– নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

পুরোনো গঠনতন্ত্রের ৫(৩) ধারায় বলা হয়েছিল, আল্লাহর আইন এবং সৎ লোকের শাসন কায়েমের মাধ্যমে জামায়াত সমাজ থেকে জুলুম, শোষণ, অবিচারের অবসানের আহ্বান জানাবে। সর্বশেষ মুদ্রিত গঠনতন্ত্রের একই ধারায় বলা হয়েছে, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করে সমাজ থেকে জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচার অবসানের আহ্বান জানাবে।

লক্ষ্য, উদ্দেশ্যে এমন পরিবর্তন বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, জামায়াত গণতান্ত্রিক উপায়ে জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে ইসলামী আদর্শ ও অনুশাসনে দেশ পরিচালনা করবে। দুর্নীতি, অবিচার, দুঃশাসন থাকবে না। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকারকে রক্ষা করা হবে।

‘জামায়াত ২.০’ আলোচনায়

গত বছর ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্য আসা জামায়াত নেতাকর্মীরা মূলধারার রাজনীতি করছেন। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক, নারী অধিকার, মানবাধিকার প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ নেতারা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন। কূটনীতিকরা একে ‘জামায়াত ২.০’ বলছেন।

সম্প্রতি দিল্লিতে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের (আইআইসি) আলোচনা সভাতেও ‘জামায়াত ২.০’ শব্দটি এসেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, সেখানে ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ঢাকা সফরে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের সঙ্গে বৈঠকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তাঁর বরাতে বলেন, ‘ধরুন, আপনারা সরকার গঠন করার মতো সংখ্যা পেয়ে গেলেন। তাহলে কি দেশে শরিয়াহ্ আইন আনতে চাইবেন? উনি (তাহের) তখন বললেন, এটা আবার কোথায় শুনলেন? আমরা কবে কোথায় বলেছি, জিতলে আমরা বাংলাদেশে শরিয়াহ্ আইন আনব!’

শ্রীরাধার সঙ্গে বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ডা. তাহের। গত বৃহস্পতিবার তিনি ফোনে সমকালকে বলেন, শ্রীরাধা যেভাবে বলেছেন, সেভাবে কথা হয়নি। তবে সারাংশ ঠিক আছে। লুকোচুরির কিছু নেই। জামায়াত খুব স্পষ্ট বলেছে– গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারলে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইনসাফ তথা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে, যা ইসলামের শিক্ষা।

জামায়াতের আমির গত এক বছরে একাধিকবার বলেছেন, তাদের দল ক্ষমতায় গেলে ব্যক্তির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। নারী তার ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরতে পারবেন। কর্মক্ষেত্র পছন্দেও নারী স্বাধীন থাকবে।

একাত্তর নিয়ে পরিবর্তন, ক্ষমায় দ্বিধা

২০০১ সালে বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে ক্ষমতার শরিক হওয়ার পর জামায়াত বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস পালন শুরু করে। অবশ্য ধরপাকড়ের কারণে আওয়ামী লীগ শাসনামলে জাতীয় দিবসগুলো প্রকাশ্যে পালন করতে পারেনি বলে জানায় জামায়াত। গত বছর ৫ আগস্টের পর জামায়াত স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালন করেছে।

হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জামায়াতের এই অবস্থান নতুন নয়। কেউ রাজনীতি করতে চাইলে বাংলাদেশ এবং সংবিধান মেনে করতে হবে। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ এবং সংবিধান মেনেই রাজনীতি করে।

তবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য ক্ষমার প্রসঙ্গে দলটির কোনো নেতা প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, ক্ষমার বিষয়ে চিন্তা থাকলেও ঐকমত্য নেই। তাদের দাবি, ১৯৮১ এবং ১৯৯৪ সালে গোলাম আযম ক্ষমা প্রার্থনা করার পরও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি শেষ হয়নি। বরং বামপন্থিরা বলেছিল, জামায়াতের ক্ষমা নেই। বিএনপি, আওয়ামী লীগও তখন এতে সায় দিয়েছিল। ২০০১ সালে তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী অতীতের সব ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন বলেও দাবি করছে জামায়াত। তখনও একই প্রতিক্রিয়া এসেছিল। তাই জামায়াত নেতাদের একাংশ মনে করে, ক্ষমা করার মানসিকতা না থাকলে ক্ষমা চাওয়া অর্থহীন।

সম্প্রতি এক বক্তব্যে জামায়াতের আমির বলেছেন, ১৯৪১ সালে দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সব ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জামায়াতের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। জামায়াতের এক নেতা সমকালকে বলেছেন, এর মধ্যে একাত্তরও রয়েছে। জামায়াত যৌথ নেতৃত্বে এবং মজলিসে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে পরিচালিত হওয়ায় একক সিদ্ধান্তে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ নেই। ইতিবাচক ভাবনা থাকলেও সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সময় লাগছে।

শ্রীরাধা দত্ত দিল্লির আলোচনা সভায় ডা. তাহেরকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘মতিউর রহমান নিজামী বা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো নেতারা কিন্তু প্রকাশ্যেই একাত্তরে জামায়াতের অবস্থানের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন! আমরা ওটা স্বীকার করেছি!’

ডা. তাহের সমকালকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। জামায়াত এগুলো অর্জন করতে চায়। এসবই এখন জামায়াতের লক্ষ্য।

ভারতের বিষয় অপরিবর্তিত

শ্রীরাধা দত্তের বরাতে বিবিসির খবরে বলা হয়, জামায়াতের তরুণ নেতৃত্ব ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে আগ্রহী। তবে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বাংলাদেশে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী হর্ষবর্ধন শ্রিংলা একই সভায় বলেন, ‘জামায়াত মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ, যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিসরসহ বিশ্বের নানা দেশেই আছে। এখানেও বক্তারা অনেকে নিশ্চয় একমত হবেন, জামায়াত আসলে কখনোই পাল্টাবে না!’

ডা. তাহের সমকালকে বলেন, প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সমতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক চায় জামায়াত। এই নীতিতে পরিবর্তন হয়নি, হবেও না।

জামায়াতের একাধিক নেতা সমকালকে বলেন, ভারত এবং ক্ষমতাসীন বিজেপির বিষয়ে আমাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা কঠিন। গত এক বছরে ৩৩ দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক হলেও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে হয়নি। ভারতীয় হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়নি জামায়াতকে।

দুজন জামায়াত নেতা তাদের মূল্যায়নে বলেছেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনকে সমর্থন করায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরী সম্পর্কও কাম্য নয়। জামায়াতের অবস্থান হলো– ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলবে না। দেশটির জন্য স্পর্শকাতর উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করবে না। তবে ভারতে চলমান মুসলিম নিপীড়ন নিয়ে কথা বলবে; প্রতিবাদ-উদ্বেগ জানিয়ে যাবে। ভারত থেকে জামায়াতবিরোধী বক্তব্য এলে জবাব দেবে, তবে ভারতবিরোধী কর্মসূচি দেবে না। আগামী নির্বাচনে ভারতবিরোধী মনোভাবের ভোটার কাছে টানার সব চেষ্টাই করবে তারা।

ট্যাগস :

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

জনপ্রিয় সংবাদ

একাত্তরের ভুল স্বীকারে দ্বিধা, তবে লক্ষ্য ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’

আপডেট সময় : ০১:৪৯:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ল্লাহর আইন চাই’– স্লোগান দেওয়া জামায়াতে ইসলামী শরিয়াহ্ শাসন কায়েমের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। দলটি বলছে, তাদের লক্ষ্য ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে ইসলামী সমাজের বদলে ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। 

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা জামায়াত একাত্তর প্রশ্নেও গত এক যুগে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তবে ক্ষমা চাইতে দলটির অভ্যন্তরে রয়েছে দ্বিধা। দলের একপক্ষের মত– ক্ষমা প্রার্থনায় লাভ হবে না। ভারতের বিষয়ে দলটির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। জামায়াত নেতারা সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। 

উদারীকরণের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে নারী নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে এনেছে জামায়াত। দলটির নারী নেতারা গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েক দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। 

জামায়াত আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় অমুসলিম সদস্যকে দলে ভেড়াচ্ছে। নারীদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করা হবে কিনা– এ নিয়ে দ্বিধা থাকলেও জামায়াত যে জোট করতে চাচ্ছে, সেখানে খোঁজা হচ্ছে অমুসলিম প্রার্থী। যদিও জামায়াতের গঠনতন্ত্রে রুকন (সদস্য) না হলে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করার সুযোগ নেই। তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক দল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে জামায়াত এতে ছাড় দিতে চায় বলে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন। 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হিজাববিহীন নারী এবং অমুসলিম প্রার্থী করেছে ছাত্রশিবির। তারা জয়ীও হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে একই কৌশল নিতে চায় জামায়াত। ডাকসুতে জয়ী ছাত্রশিবির নেতারা ১১ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জন্য দোয়া করেন দলীয় সিদ্ধান্তেই। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, উদারীকরণের অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে এমন কাজের ধারাবাহিকতা থাকবে। ক্ষমতায় যেতে পারলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া জামায়াত দলের লোগো বদল করে কিতাব ও কলম যুক্ত করেছে। গতকালই এই লোগো বদল করার বিষয়টি খবর হয়েছে।

জামায়াতে রক্ষণশীল এবং উদারপন্থির মতবিরোধ পুরোনো। ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো ধরপাকড়ের মুখে তা স্পষ্ট হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলীরা উদারপন্থি অংশে ছিলেন। একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করা নেতাদের বাদ দিয়ে কামারুজ্জামান নতুন নামে দল গঠনের জন্য কারাগার থেকে লিখিত পরামর্শ দিয়েছিলেন।

একাত্তরের জন্য ক্ষমা না চাওয়ায় ২০১৯ সালে জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এরও কয়েক বছর আগে তিনি তুরস্ক, তিউনিসিয়া ও মিসরের আদলে মধ্যপন্থি দল গঠনের পরামর্শ দিয়ে কলাম লিখেছিলেন। তাঁর চিন্তা ছিল, জামায়াত হবে সামাজিক সংগঠন। নির্বাচনে অংশ নেবে না। জামায়াত একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল থাকবে, যেখানে সব ধর্মের মানুষ থাকবে। তবে কারাগার থেকে আবু নকীব নামে লেখা কলামে সাবেক আমির মতিউর রজমান নিজামী এ চিন্তা নাকচ করেন।

তরুণ নেতাদের দাবির মুখে নতুন নামে দল গঠনে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান আমির এবং তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কমিটিও করেছিল জামায়াত। যদিও সেই উদ্যোগ দলটির মজলিসে শূরা অনুমোদন করেনি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে দল গঠন করিয়েছিল আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াত। উদ্দেশ্য ছিল, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে বিডিপির নামে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া। যদিও সেই দলকে নিবন্ধন দেয়নি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। গত বছর ৫ আগস্টের পর দলটি নিবন্ধন পেয়েছে।

গত বছর ১ আগস্ট জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ। গণঅভ্যুত্থানের পর তা প্রত্যাহার করে অন্তর্বর্তী সরকার। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হয়ে পড়ায় বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে জামায়াত। ক্ষমতায় গেলে কী কী করবে, সেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অতীতে কখনও ১৭ আসনের বেশি না পাওয়া দলটি। শফিকুর রহমান একাধিক বক্তব্যে বলেছেন, মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রই জামায়াতের লক্ষ্য।

ইসলামী সমাজ থেকে ইনসাফের সমাজের লক্ষ্য

২০০৬ সালে মুদ্রিত জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছিল, ‘… আল্লাহর বিধান ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি দিক এবং বিভাগে প্রতিষ্ঠা করিয়া মানুষ পার্থিব কল্যাণ এবং আখেরাতের সাফল্য অর্জন করিতে পারে; সেহেতু এই মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।’

২০০৮ সালে নিবন্ধনের সময় প্রথম গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৯ সালে সংশোধিত এবং গত বছর ডিসেম্বরে সর্বশেষ মুদ্রিত গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘… যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়া বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করিয়াছে, সেহেতু এই সকল মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত ন্যায় এবং ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।’

গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জামায়াত ২০১৬ সালে ‘শোষণমুক্ত ন্যায় এবং ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের’ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। পুরোনো গঠনতন্ত্রে দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কিত তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছিল, আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসুল (সা.) প্রদর্শিত দ্বীন কায়েম হবে জামায়াতের লক্ষ্য। সর্বশেষ মুদ্রিত গঠনতন্ত্রের একই ধারায় বলা হয়েছে, জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো– নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

পুরোনো গঠনতন্ত্রের ৫(৩) ধারায় বলা হয়েছিল, আল্লাহর আইন এবং সৎ লোকের শাসন কায়েমের মাধ্যমে জামায়াত সমাজ থেকে জুলুম, শোষণ, অবিচারের অবসানের আহ্বান জানাবে। সর্বশেষ মুদ্রিত গঠনতন্ত্রের একই ধারায় বলা হয়েছে, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করে সমাজ থেকে জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচার অবসানের আহ্বান জানাবে।

লক্ষ্য, উদ্দেশ্যে এমন পরিবর্তন বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, জামায়াত গণতান্ত্রিক উপায়ে জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে ইসলামী আদর্শ ও অনুশাসনে দেশ পরিচালনা করবে। দুর্নীতি, অবিচার, দুঃশাসন থাকবে না। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকারকে রক্ষা করা হবে।

‘জামায়াত ২.০’ আলোচনায়

গত বছর ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্য আসা জামায়াত নেতাকর্মীরা মূলধারার রাজনীতি করছেন। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক, নারী অধিকার, মানবাধিকার প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ নেতারা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন। কূটনীতিকরা একে ‘জামায়াত ২.০’ বলছেন।

সম্প্রতি দিল্লিতে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের (আইআইসি) আলোচনা সভাতেও ‘জামায়াত ২.০’ শব্দটি এসেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, সেখানে ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ঢাকা সফরে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের সঙ্গে বৈঠকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তাঁর বরাতে বলেন, ‘ধরুন, আপনারা সরকার গঠন করার মতো সংখ্যা পেয়ে গেলেন। তাহলে কি দেশে শরিয়াহ্ আইন আনতে চাইবেন? উনি (তাহের) তখন বললেন, এটা আবার কোথায় শুনলেন? আমরা কবে কোথায় বলেছি, জিতলে আমরা বাংলাদেশে শরিয়াহ্ আইন আনব!’

শ্রীরাধার সঙ্গে বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ডা. তাহের। গত বৃহস্পতিবার তিনি ফোনে সমকালকে বলেন, শ্রীরাধা যেভাবে বলেছেন, সেভাবে কথা হয়নি। তবে সারাংশ ঠিক আছে। লুকোচুরির কিছু নেই। জামায়াত খুব স্পষ্ট বলেছে– গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারলে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইনসাফ তথা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে, যা ইসলামের শিক্ষা।

জামায়াতের আমির গত এক বছরে একাধিকবার বলেছেন, তাদের দল ক্ষমতায় গেলে ব্যক্তির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। নারী তার ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরতে পারবেন। কর্মক্ষেত্র পছন্দেও নারী স্বাধীন থাকবে।

একাত্তর নিয়ে পরিবর্তন, ক্ষমায় দ্বিধা

২০০১ সালে বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে ক্ষমতার শরিক হওয়ার পর জামায়াত বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস পালন শুরু করে। অবশ্য ধরপাকড়ের কারণে আওয়ামী লীগ শাসনামলে জাতীয় দিবসগুলো প্রকাশ্যে পালন করতে পারেনি বলে জানায় জামায়াত। গত বছর ৫ আগস্টের পর জামায়াত স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালন করেছে।

হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জামায়াতের এই অবস্থান নতুন নয়। কেউ রাজনীতি করতে চাইলে বাংলাদেশ এবং সংবিধান মেনে করতে হবে। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ এবং সংবিধান মেনেই রাজনীতি করে।

তবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য ক্ষমার প্রসঙ্গে দলটির কোনো নেতা প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, ক্ষমার বিষয়ে চিন্তা থাকলেও ঐকমত্য নেই। তাদের দাবি, ১৯৮১ এবং ১৯৯৪ সালে গোলাম আযম ক্ষমা প্রার্থনা করার পরও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি শেষ হয়নি। বরং বামপন্থিরা বলেছিল, জামায়াতের ক্ষমা নেই। বিএনপি, আওয়ামী লীগও তখন এতে সায় দিয়েছিল। ২০০১ সালে তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী অতীতের সব ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন বলেও দাবি করছে জামায়াত। তখনও একই প্রতিক্রিয়া এসেছিল। তাই জামায়াত নেতাদের একাংশ মনে করে, ক্ষমা করার মানসিকতা না থাকলে ক্ষমা চাওয়া অর্থহীন।

সম্প্রতি এক বক্তব্যে জামায়াতের আমির বলেছেন, ১৯৪১ সালে দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সব ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জামায়াতের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। জামায়াতের এক নেতা সমকালকে বলেছেন, এর মধ্যে একাত্তরও রয়েছে। জামায়াত যৌথ নেতৃত্বে এবং মজলিসে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে পরিচালিত হওয়ায় একক সিদ্ধান্তে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ নেই। ইতিবাচক ভাবনা থাকলেও সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সময় লাগছে।

শ্রীরাধা দত্ত দিল্লির আলোচনা সভায় ডা. তাহেরকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘মতিউর রহমান নিজামী বা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো নেতারা কিন্তু প্রকাশ্যেই একাত্তরে জামায়াতের অবস্থানের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন! আমরা ওটা স্বীকার করেছি!’

ডা. তাহের সমকালকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। জামায়াত এগুলো অর্জন করতে চায়। এসবই এখন জামায়াতের লক্ষ্য।

ভারতের বিষয় অপরিবর্তিত

শ্রীরাধা দত্তের বরাতে বিবিসির খবরে বলা হয়, জামায়াতের তরুণ নেতৃত্ব ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে আগ্রহী। তবে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বাংলাদেশে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী হর্ষবর্ধন শ্রিংলা একই সভায় বলেন, ‘জামায়াত মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ, যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিসরসহ বিশ্বের নানা দেশেই আছে। এখানেও বক্তারা অনেকে নিশ্চয় একমত হবেন, জামায়াত আসলে কখনোই পাল্টাবে না!’

ডা. তাহের সমকালকে বলেন, প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সমতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক চায় জামায়াত। এই নীতিতে পরিবর্তন হয়নি, হবেও না।

জামায়াতের একাধিক নেতা সমকালকে বলেন, ভারত এবং ক্ষমতাসীন বিজেপির বিষয়ে আমাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা কঠিন। গত এক বছরে ৩৩ দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক হলেও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে হয়নি। ভারতীয় হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়নি জামায়াতকে।

দুজন জামায়াত নেতা তাদের মূল্যায়নে বলেছেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনকে সমর্থন করায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরী সম্পর্কও কাম্য নয়। জামায়াতের অবস্থান হলো– ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলবে না। দেশটির জন্য স্পর্শকাতর উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করবে না। তবে ভারতে চলমান মুসলিম নিপীড়ন নিয়ে কথা বলবে; প্রতিবাদ-উদ্বেগ জানিয়ে যাবে। ভারত থেকে জামায়াতবিরোধী বক্তব্য এলে জবাব দেবে, তবে ভারতবিরোধী কর্মসূচি দেবে না। আগামী নির্বাচনে ভারতবিরোধী মনোভাবের ভোটার কাছে টানার সব চেষ্টাই করবে তারা।