তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি “যদি”, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যে সময় নির্ধারণ করেছেন সেটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। কারণ, ৪টি কমিশনের রিপোর্ট তিনি জানুয়ারির মধ্যে পেয়ে যাবেন। আর কয়েকটি কমিশনের রিপোর্ট পেতে দুই মাস দেরি হতে পারে। এরপরও যে সময় থাকবে তাতে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব। অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকার ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। শুধু সংবিধানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে না। এখন যে গতিতে সংস্কার কাজ চলছে, সেটার গতি আর একটু বাড়াতে হবে। তাহলে আমার মনে হয় প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ের মধ্যে যৌক্তিক নির্বাচন সম্ভব।’
বিএনপি মনে মনে, সম্ভাব্য সময় নয়, নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রয়োজন। দলটির যুগ্ম মহাসচিব ইমরান সালেহ প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে “কিন্তু”, “যদি”, “তবে” আছে। আমরা এগুলো শুনতে চাই না। তারপরও বলব, তিনি যে একটা সময় অন্তত বলেছেন সেটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমরা মনে করি, জরুরি যে সব সংস্কারের প্রয়োজন সেগুলো এর মধ্যেই করা সম্ভব। একই সঙ্গে সংস্কার কাজও চলবে, আবার নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলবে। সেভাবেই সরকার এগুবে বলে দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেন। তাই আমরা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়ার দাবি জানাই।’
আগামী দুই মাসের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসরদের বিচারের আগে দেশে কোনও নির্বাচন হবে না।’
সোমবার বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটি এখনও রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিনি। আমরা একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ, যে উদ্যোগগুলো ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে অনেকগুলো শক্তি মাঠে এসেছিল, যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছিল এবং যারা বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজাতে চায়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশকে একটি সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। আগামীর বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে স্বপ্নভূমি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করতে চায়। সে জায়গা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক-দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে একটি সুন্দর দল উপহার দেবে।’
‘ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসরদের বিচারের আগে দেশে কোনও নির্বাচন হবে না।’ নাগরিক কমিটির এই ঘোষণাকে কীভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এটা তো যৌক্তিক। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান তো শুধু একটা নির্বাচনের জন্য হয়নি। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট হয়েছে, সেই প্রক্রিয়া বন্ধ না করে নির্বাচন দিলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। আবার যদি আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে এই অভ্যুত্থানের দাম কী থাকল? ফলে নির্বাচনের আগে তো ফ্যাসিস্টদের বিচার হতে হবে। এখন নির্বাচনের জন্য এই সরকারকে চাপ দেওয়া ঠিক হবে না। এটা তো একটা নির্দলীয় সরকার। এই সরকারকে তো আমরা সবাই ‘ওন’ করছি। ফলে তারা যদি সংস্কার কাজ না করে আমাদের চাপাচাপিতে অভিমানে যেনতেন একটা নির্বাচন দিয়ে চলে যান তাহলে তো জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। সংস্কার কাজ করার জন্য তাদের যৌক্তিক সময় দিতে হবে। তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে নির্বাচনের সময়ের কথা বলেছেন তাকে আমরা স্বাগত জানাই।’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। তিনি তো পরিষ্কার করে বলেছেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে যদি প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে আরও ৬ মাস সময় লাগবে। সেটা তো ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে হবে। ফলে এখানে কোন ফাঁক আমি দেখি না। আমি মনে করি, প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ইতিবাচক।’
আর গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখি। আগামী জানুয়ারিতে সংস্কার কমিশনগুলোর কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার হয়ত আরও সুনির্দিষ্ট করে রোডম্যাপ জানাতে পারবে। জনগনের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ আছে। এটা একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি মনে করি, প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গন, অর্থনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক হবে।’
এই নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল অংশ নেবে, আর কোন দল নেবে না সেটি এখনও পরিষ্কার নয়। জাতীয় পার্টিকে (এরশাদ) ফ্যাসিস্টের সহযোগী আখ্যা দিয়ে তাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার দাবি জানিয়ে আসছে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও গণঅধিকার পরিষদ। এই পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে জাতীয় পার্টি কীভাবে দেখছে? জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘মঙ্গলবার আমরা মিটিং করে আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত জানাবো। শুধু এটুকু বলতে পারি, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে সেটা অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবি জানাই। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে নিয়ে আসার দায়িত্ব সরকারকেই পালন করতে হবে।’