আবহমান গ্রাম বাংলার অতি প্রাচীন কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও নিজস্বতা ধরে রাখতে হাজারো প্রাণের আনন্দ উচ্ছলতায় আয়োজন করা হয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। কালের বির্বতনে তা যেন আজ হারিয়ে গেলেও আনন্দঘন পরিবেশে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়।
নেই কোন আয়োজক, নেই কোন পুরস্কার। অথচ বছরের পর বছর লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কালিগঞ্জে আনন্দমূখর পিরেবেশে ৩ দিনব্যাপী নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ নৌকা বাইচ প্রচীন ঐতিহ্যবাহী বিল বাঘিয়ার নৌকা বাইচ হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছরের মতো এ বছরও এই নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের মিলন মেলা বসে কোটালীপাড়ার কালিগঞ্জে।
গত শুক্রবার আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে আজ রবিবার শেষ হয় নান্দনিক এ নৌকা বাইচ। কালিগঞ্জ নদীতে কালিগঞ্জ বাজার থেকে খেজুরবাড়ি পর্যন্ত ২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যে লালিত দু’শ বছরের আকর্ষনীয় এ নৌকা বাইচে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, পিরোজপুর ,নড়াইল, বরিশাল জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের শতাধিক সরেঙ্গা, ছিপ, কোষা, চিলাকাটা, জয়নগর বাচারী নৌকা অংশ নেয়।
বর্ণিল সাজে সজ্জিত দৃষ্টি নন্দন নৌকাগুলো দুপুর থেকে তুমুল বাইচ শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নৌকা বাইচের একের পর এক ছোপ।
নৌকা বাইচ দেখতে ছুটে এসেছে শিশু থেকে বৃদ্ধরাও। তবে নানা রং বেরংয়ের শাড়ী পড়ে ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলারে করে নৌকা বাইচ দেখতে আসা নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। নদীর দুই পাড়ে কোথাও ফাঁকা জায়গা নেই। হাজার হাজার মানুষ যেন একে অপরের সাথে লেপ্টে থাকে নৌকা বাইচ উপভোগের জন্য।
কাশির বাদ্যে ও তালে জারি সারি গান গেয়ে এবং নেচে— হেঁইও হেঁইও রবে বৈঠার ছলাৎ—ছলাৎ শব্দে এক অনবদ্য আবহ সৃষ্টি হয়। এসময় দু’কূলে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে জাগে দোলা।
নৌকা বাইচ উপলক্ষে হরেক রকমের দোকানের পসরা বসেছে। নানা স্বাদের মুখরোচক গ্রামীণ খাবার থেকে শুরু করে খেলনাসহ গৃহস্থলীকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের সমাহার ঘটেছে ফুটপাতের এসব ছোট ছোট দোকানে।
পার্শ্ববর্তী কালকিনি উপজেলার নবগ্রাম থেকে নৌকা বাইচ দেখতে আসা কলেজ পড়–য়া তপতী রায় বলেন, এবারই প্রথম নৌকা বাইচ দেখার সুযোগ হয়েছি। পরিবারের সাথে ঢাকায় থাকি। নৌকা বাইচ দেখার জন্যই বাড়িতে এসেছি। নৌকা বাইচ না দেখলে জানতে পারতাম না, বাইচ এতো মনোরম ও সুন্দর হয়। এসে দেখলাম উৎসবে পরিণত হয়েছে পুরো অঞ্চল।
বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার বাসিন্দা শিবানী সাহা বলেন, এবারই প্রথম নৌকা বাইচ দেখার সুযোগ হয়েছে, আমি আগে কখনো দেখিনি। নৌকা বাইচ না দেখলে জানতে পারতাম না, বাইচ এতো মনোরম ও সুন্দর হয়। এসে দেখলাম, উৎসবে পরিণত হয়েছে পুরো অঞ্চল।
নৌকা বাইচ দেখতে আসা গৃহিনী নমিতা বৈদ্য ও তৃষ্ণা রায় বলেন, জীবনে অনেক স্থানের নৌকা বইচ দেখেছি। কিন্তু এখানকার মতো এত বড় ও সুন্দর রাজকীয় ঢং এর নৌকা বাইচ অন্য কোথাও দেখিনি।
কলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজন বিশ্বাস বলেন, জলাভূমি বেষ্টিত কোটালীপাড়ার জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল নৌকা। প্রায় দু’শত বছর আগে লক্ষ্মী পূজার সময় নৌকা নিয়ে এলাকার মানুষ জমিদার শিবরাম চৌধুরীর বাড়িতে যেতেন। পূজা দেখে ফেরার সময় নৌকায় নৌকায় পাল্লা হতো। নৌকার মাধ্যমে চিত্তবিনোদনের চিন্তা থেকে নৌকা বাইচের প্রচলন শুরু হয়। সে থেকেই লক্ষ্মী পূজার পরের দিন থেকে এ অঞ্চলের নৌকা বাইচ হয়ে আসছে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নৌকাবাইচ বিলুপ্ত হলেও কোটালীপাড়া উপজেলার কালিগঞ্জের নৌকাবাইচ এখনও বর্ণিল।
নৌকা বাইচ দেখতে আসা শুয়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যজ্ঞেশ্বর বৈদ্য অনুপ বলেন, ছোট বেলা থেকেই এ নৌকা বাইচ দেখে আসছি। এখানে কখনোই কাউকে বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে বাইচের আয়োজন করতে হয়না। স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এ এলাকার লোকজন এই নৌকা বাইচের আয়োজন করে থাকে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহীনুর আক্তার বলেন, কোটালীপাড়া উপজেলার কালিগঞ্জে নৌকাবাইচ এই অঞ্চলের কৃষ্টি কালচারের একটি অংশ। গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ এই নৌকাবাইচ উপভোগ করতে এখানে আসেন। পরিনিত হয় মিলন মেলায়। যে কারণে দর্শনার্থীদের জন্য এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ৩ দিনের এই নৌকা বাইচ নির্বিঘ্নে শেষ করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। #