মেক্সিকোতে দুই নারীর বিরল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে অল্প কয়েক দিন আগে সে দেশের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদে রেকর্ড সংখ্যক নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। লিঙ্গসমতা প্রশ্নে যদিও এই ফল প্রশংসার দাবি রাখে; কিন্তু নারীর সামগ্রিক অগ্রগতির দিক বিবেচনা করলে এই সাফল্য খুবই অপ্রতুল।
বড় ক্যানভাসে দেখলে বলা যায়, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সামগ্রিক চিত্র হতাশাজনক। উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক আরেকটি নির্বাচনের কথা ধরা যাক। বর্ণবৈষম্যের অবসান এবং প্রথম অবাধ ভোটের ৩০ বছর পর দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় সেখানকার জনগণ অন্যান্য ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতায় ভালো অগ্রগতি পেলেও এখনো তারা দেশের সর্বোচ্চ পদে একজন নারীকে নির্বাচিত করার সুযোগ পায়নি। গত মার্চে পর্তুগালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে মাত্র ৭৬ জন নারী নির্বাচিত হয়েছেন। গত মেয়াদে সেখানে নারী এমপির সংখ্যা ছিল ৮৫।
আমরা এখন এমন একটি মহা নির্বাচনের বছর পার করছি, যখন নাকি বিশ্বে যত সংখ্যক মানুষ আছে, তার প্রায় অর্ধেকই ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। অথচ এই সময়টাতেও রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব একেবারেই কম দেখা যাচ্ছে। এ বছর ভোটের আয়োজন করা তিনটি বৃহত্তম দেশ ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ নির্বাহী পদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সবাই পুরুষ। আফ্রিকার ১৯টি দেশে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ভোটাভুটি হবে। শুধু নামিবিয়ায় একজন নারীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের লিঙ্গসমতা–সম্পর্কিত বৈশ্বিক লক্ষ্য ও প্রতিশ্রুতিগুলো এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য বলছে, বর্তমানে নারীর অগ্রগতির যে প্রবণতা আছে, সেটি ধরে রাখতে পারলেও পার্লামেন্ট ও অন্য নির্বাচনভিত্তিক সংস্থাগুলোতে পুরুষের সমান নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আরও ৪৭ বছর সময় লাগবে। তার মানে লিঙ্গসমতা প্রশ্নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি ৫) অর্জনে যে ৪১ বছরের সময়সীমা ঠিক করা আছে, তা পার হয়ে যাবে।
রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা শুধু যে নৈতিকভাবে ঠিক তা-ই নয়, এটি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে নানা সুবিধাও দেয়। নারীরা যখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে বসেন, তখন তাঁরা জনগণের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের সুবিধা নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে সাশ্রয়ী খরচে শিশু যত্ন দেওয়া পর্যন্ত বিষয়ে অধিকতর যত্নবান হন। নারী নেতৃত্বের কারণে টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রীয় নীতিগুলোর ওপর জোর দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
যে দেশগুলো এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে এবং লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, সেখানে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলে তাদের মানবাধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। গবেষণায় এ–ও দেখা গেছে যে নীতি নির্ধারণে নারীর অনন্য অভিজ্ঞতা যুক্ত হলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাও উন্নত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলে জনজীবন অধিকতর অশান্ত হলেও এবং পশ্চাদপসরণমূলক ও কর্তৃত্ববাদী শাসন অনুভব করতে শুরু করলেও অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা এই প্রবণতার রাশ টেনে ধরার সংগ্রাম করেছেন।
তাঁদের আন্দোলনের ফল হিসেবে এই বছরের নির্বাচনে আমরা অনেক জায়গায় অনেক বিরক্তিকর প্রবণতাকে উল্টে যেতে দেখছি। এসব কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বে অধিক সংখ্যক নারীকে নির্বাচিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অর্থবহ ও টেকসই অগ্রগতির জন্য সরকার এবং জনসেবামূলক সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
শুধু লিঙ্গসমতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এমন প্রকল্পগুলোকে ২০২২ সালে এসডিজি–সম্পর্কিত কোনো তহবিল দেওয়া হয়নি। অথচ বাস্তবতা হলো এসডিজির অন্যান্য ১৬টি লক্ষ্য থেকে লিঙ্গসমতাবিষয়ক এসডিজি-৫ অনেক পিছিয়ে রয়েছে এবং এ বিষয়ে অর্থায়নের ঘাটতির প্রভাব ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে। নারী নেত্রী হিসেবে লিঙ্গসমতাবিষয়ক নিষ্ক্রিয়তার কথা মনে করিয়ে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
আসুন আমরা ২০২৪ সালকে নতুন প্রজন্মের নারীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার একটি বছর হিসেবে গড়ে তুলি। আমরা একসঙ্গে কাজ করলে এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে রাজনীতিতে নারীরাই ক্ষমতাধর চালিকা শক্তি হিসেবে নিজেদের দাঁড় করাতে পারবেন।
● এলেন জনসন সারলিফ শান্তিতে নোবেলজয়ী ও লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট, যিনি আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে প্রথম কোনো নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট এবং
● বিনাইফার নওরোজি ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট |