আরও একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট এবং আরও একবার মুখোমুখি ভারত এবং পাকিস্তান। এবারের টুর্নামেন্টটিকে স্রেফ বৈশ্বিক বলা যাবে না। মহাদেশীয় বলাই স্রেয়। এশিয়া কাপ ক্রিকেটে আগামী রোববারই মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ক্রিকেটের দুই মহাপ্রতিদ্বন্দ্বী। ম্যাচটি ঘিরে উত্তেজনার কমতি নেই ভারত এবং পাকিস্তানে।
ভারতীয় তারকা বিরাট কোহলি দীর্ঘদিন ভুগছেন অফ ফর্ম আর রান খরায়। কিন্তু এবার পাকিস্তানের বিপক্ষেই যেন নিজের স্বরূপে আবির্ভূত হতে পারেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এই ব্যাটার- সে কামনাই করছেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি পেসার ওয়াসিম আকরাম এবং ভারতের সাবেক কোচ এবং অধিনায়ক রবি শাস্ত্রি।
শনিবার থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে শুরু হতে যাচ্ছে এশিয়া কাপের আসর। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এবারের আসরে ২৮ তারিখ তথা রোববারই মুখোমুখি হচ্ছে ভারত এবং পাকিস্তান। সম্প্রচারকারী চ্যানেল স্টার স্পোর্টসে ধারাভাষ্য দিতে দেখা যাবে বিখ্যাত ‘শ্যাজ-ওয়াজ’ জুটিকে। অর্থাৎ, রবি শাস্ত্রি এবং ওয়াসিম আক্রামকে।
মঙ্গলবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আসন্ন ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট মহারণ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অনেক কথাই বলেছেন শাস্ত্রি এবং আক্রাম…
ভারত-পাক দ্বৈরথ
রবি শাস্ত্রি: ভারত-পাকিস্তান লড়াই মানেই একটা অন্য ম্যাচ। ক্রিকেটারদের কাছেও। তবে চাপটা কিন্তু আসে বাইরে থেকে। যেখানেই যাবেন, পাক-ভারত ম্যাচ নিয়ে কথা চলবে। তাই বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, ভুলে গিয়ে নিজের খেলাটার উপরে জোর দিতে হবে। পাকিস্তান বলে চাপ নিলে চলবে না। এখন গণমাধ্যমের ব্যাপারটাও আছে। তাই ম্যাচের দু’দিন আগে এবং একদিন পরে গণমাধ্যম থেকে দূরে থাকতে হবে।
ওয়াসিম আক্রাম: ভারত-পাক দ্বৈরথের আগে সমর্থকদের একটা কথা বলতে চাই। ভুলে যাবেন না এটা কিন্তু আর একটা ক্রিকেট ম্যাচ। কেউ জিতবে, কেউ হারবে। ম্যাচটা যদি দারুণ জমে যায়, তা হলেই সবার খুশি হওয়া উচিত।
বিরাট কোহলির ফর্ম
শাস্ত্রি: আমার সঙ্গে বিরাটের কথা হয়নি। কিন্তু জানি, বিশ্রাম নিয়ে তরতাজা হয়ে মাঠে ফিরতে তৈরি সে। মাঠের বাইরে যে সময়টা সে পেয়েছে, তাতে নিঃসন্দেহে ভেবেছে কী করা উচিত ছিল, এখন কিভাবে খেলা উচিত। আমি নিশ্চিত, বিরাট অত্যন্ত শান্ত মনে খেলতে নামবে। আর প্রথম ম্যাচে হাফসঞ্চুরি পুরো ছবিটা বদলে দিতে পারে। সবার মুখ বন্ধ করে দেবে। বিরাটকে শান্ত মনে খেলতে হবে। সে নিঃসন্দেহে সেরা ফর্মে ফিরবে। বলে দিচ্ছি, বিরাট কিন্তু ক্ষুধার্ত।
আক্রাম: প্রথমেই বলি, ভারতীয় সমর্থকদের বিরাটের সমালোচনা করার কোনও মানে হয় না। সে সর্বকালের অন্যতম সেরা। বিরাটের বয়স এখন ৩৩। তার মতো ফিট ক’জন আছে! সেই চিরাচরিত কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। ফর্ম সাময়িক; কিন্তু জাতটা চিরকালীন। আমি নিশ্চিত সে ফিরে আসবে। (হাসতে হাসতে) আমি শুধু চাইব, পাকিস্তানের সঙ্গে যাতে রানটা না করে বিরাট।
বাবর-বিরাট তুলনা
আক্রাম: এই তুলনাটা ওঠা স্বাভাবিক। অতীতে শচিন টেন্ডুলকারের সঙ্গে ইনজামাম-উল-হকের হত। সুনিল গাভাস্কারের সঙ্গে জাভেদ মিয়াঁদাদের হত। বাবরের টেকনিক খুব ভাল বলে সে এত ধারাবাহিক। সে ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছে; কিন্তু বিরাটের সঙ্গে বাবরের এখনই তুলনা করার সময় আসেনি।
দু’দলের অবস্থান
শাস্ত্রি: ভারত এখন শুরুতে যে আগ্রাসী ক্রিকেটটা খেলছে, সেটাই খেলা উচিত। আমি কোচ থাকার সময় একবার ড্রেসিংরুমে আলোচনা করেছিলাম যে, আমাদের শুরুটা সে রকম দাপটের সঙ্গে হচ্ছে না। ভারতীয় দলে এখন অনেক বিধ্বংসী ক্রিকেটার আছে। যেমন রিশাভ পান্থ, হার্দিক পান্ডিয়া, রবিন্দ্র জাদেজা। তাই শুরুতে ও রকম আগ্রাসী মানসিকতা দেখানো যেতেই পারে। শুরুতে বাড়তি ঝুঁকি নেওয়া যেতেই পারে।
আক্রাম: গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতকে হারানোর পরে পাকিস্তানের মানসিকতা বদলে গিয়েছে। ওই ম্যাচের পরে পাকিস্তান বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, বিশ্বমঞ্চে ভারতকে হারানোর ক্ষমতা ওদের আছে। তবে পাকিস্তানের এই দলটার একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তায় আছি। মাঝের সারির ব্যাটিং। সে রকম কোনও অভিজ্ঞ ব্যাটার নেই বাবরদের হাতে।
শাহিন আফ্রিদির না থাকা
আক্রাম: শাহিনের অভাব ভিষণভাবে টের পাবে পাকিস্তান। সে নতুন বলে উইকেট নেয়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রান ওঠার গতি আটকাতে গেলে উইকেট নিতে হবে। শাহিন সেটাই করে। উল্টো দিকে কে আছে না দেখে স্টাম্পে আক্রমণ করে যায়। শাহিন না থাকা মানে পাকিস্তান বোলিং আক্রমণে সবাই ডানহাতি পেসার। কোনো বৈচিত্র্য থাকছে না।
শাস্ত্রি: ভারত যে সব ম্যাচ হেরেছে, তার অনেকগুলোর পিছনেই কিন্তু বিপক্ষের বাঁ-হাতি পেসারের অবদান আছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে মোহাম্মদ আমির, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শাহিন। আবার কখনও বা ট্রেন্ট বোল্ট সংহারক হয়েছে। বাঁ-হাতি পেসাররা দু’-তিন ওভারে খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে। ১৯৯২ বিশ্বকাপ ফাইনালে ওয়াসিম আক্রাম করে দেখিয়েছিল। ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক প্রথম ওভারেই ব্রেন্ডন ম্যাককালামের স্টাম্প ছিটকে দিয়ে নিউজিল্যান্ডের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। বাঁ-হাতি থাকা মানেই বোলিং আক্রমণে বৈচিত্র্য আসা।
দু’দলের প্রধান অস্ত্র
আক্রাম: ভারতীয় দলে অনেকেই আছে। রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুল, কোহলি। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এই মুহূর্তে আমার পছন্দের ক্রিকেটার হল সূর্যকুমার যাদব। সূর্যকে প্রথম দেখি কলকাতা নাইট রাইডার্সে। তখন বেশ কয়েকটা দারুণ ইনিংস খেলেছিল। আর ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকে তো চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং করছে।
অফ-মিডল স্টাম্পে সরে গিয়ে লেগসাইডে সূর্য একটা ফ্লিক শট মারে। ওই রকম শট খেলা প্রচণ্ড কঠিন। কিন্তু ও খুব স্বাভাবিক ভাবেই শটটা খেলে। ও খুব বিপজ্জনক ব্যাটার। সূর্যকে ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটসম্যান বলাই যায়। উইকেটের যে কোনো দিকে শট খেলতে পারে। পেস-স্পিন দু’ধরনের বোলিংয়ের বিরুদ্ধেই সাবলীল।
আর পাকিস্তানের সেরা অস্ত্র হল বাবর-রিজওয়ান। ওরা কিন্তু পিঞ্চহিটার নয়। পিঞ্চহিটারদের আউট করার সুযোগ পাওয়া যায়। রাহুল-রোহিতের মতো বাবর-রিজওয়ানও টেকনিক্যালি খুব ভাল। আউট হওয়ার সুযোগ দেয় না। ভাল বলেও শট খেলে। তাই ভারতকে ওদের নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
হার্দিক পান্ডিয়ার উপস্থিতি
শাস্ত্রি: হার্দিক হল ভারতীয় দলটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। সে না খেললেই ভারসাম্য নষ্ট হবে। তখন হয় একজন বাড়তি বোলার বা বাড়তি ব্যাটার খেলাতে হবে। গত বছর বিশ্বকাপে হার্দিক বল করতে পারেনি। যেটা আমাদের ভীষণ ভুগিয়েছিল। আর ওই জায়গায় খেলার মতো হার্দিকের বিকল্প কোনও ক্রিকেটারই নেই। ওকে নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। বিশ্বকাপের আগে বেশি ম্যাচ খেলতে গিয়ে চোট না পেয়ে যায়।
এশিয়া কাপ কে জিতবে
শাস্ত্রি: এবার দারুণ একটা প্রতিযোগিতা হতে চলেছে। আমরা ভারত-পাকিস্তানের কথা বলছি ঠিকই; কিন্তু মনে রাখতে হবে, এশীয় ক্রিকেট এখন খুবই শক্তিশালি। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানকে হাল্কাভাবে নেওয়ার প্রশ্নই নেই। একটা টস হারা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ফেভারিট অবশ্যই ভারত-পাকিস্তান। কিন্তু এই ফর্ম্যাটে যে কোনও দল যে কাউকে হারানোর ক্ষমতা রাখে।
আক্রাম: ঠিক। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে কী হবে, বলতে পারব না। তবে ‘শ্যাজ’-এর মতোই বলব, দলগুলোর মধ্যে পার্থক্য কমে আসছে। শ্রীলঙ্কা খুবই বিপজ্জনক দল। বাংলাদেশকে আমি ইদানিং সেভাবে দেখিনি। আফগানিস্তানের হাতে ম্যাচ জেতানো বোলার আছে। এমন সব ব্যাটার আছে যারা আউট হতে ভয় পায় না। মনে হচ্ছে এবারই সেরা এশিয়া কাপ দেখতে যাচ্ছি।